মাদক ছড়িয়েছে পাড়া-মহল্লায়, নিয়ন্ত্রণহীন কিশোর গ্যাং

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

মাদক ছড়িয়েছে পাড়া-মহল্লায়, নিয়ন্ত্রণহীন কিশোর গ্যাং
শ্রমিক অধ্যুষিত এবং ঘনবসতিপূর্ণ জেলা নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে মাদকের বিস্তার। ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল- সব ধরনের মাদক শহর ও আশপাশের এলাকায় সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। শহরের একাধিক চিহ্নিত জায়গা এখন মাদক ব্যবসায়ীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।
মাদকের ছড়াছড়ির পাশাপাশি ‘কিশোর গ্যাং’-এর অপরাধমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাত্রাও গত কয়েকমাসে বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। কিশোর ও তরুণ বয়সী যুবকরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে একে-অপরের সঙ্গে প্রায়ই সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। গত কয়েকমাসে নারায়ণগঞ্জ জেলায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বেশ কয়েকটি ঘটনার নেপথ্যের কারণ মাদক ও কিশোর গ্যাং।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহরের চাঁদমারী বস্তি, টানবাজার সুইপার কলোনি এবং জিমখানা বস্তি- এই তিনটি স্থান বহু আগে থেকেই ‘মাদকের আখড়া’ হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও শহরতলির বাবুরাইল, কাশীপুর, হাটখোলা, ভোলাইল, পানির ট্যাংকি, পাইকপাড়া এবং হোসাইনীনগরের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কয়েকটি পয়েন্টে সড়কের উপর প্রকাশ্যেই মাদকের বেচাকেনা চলছে। কেউ এ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলে প্রতিকার তো মেলেই না বরং মাদক বিক্রেতাদের রোষানলেও পড়তে হয় বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। মাদকের এ সহজলভ্যতার কারণে সেবনের পাশাপাশি মাদক বিক্রির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছেন কিশোর ও তরুণ বয়সীরা। এই মাদক-সম্পৃক্ততা পরে তাদের কিশোর অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। স্থানীয়ভাবে আধিপত্য ধরে রাখতে প্রায়শ’ কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা সশস্ত্র মহড়া দেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। তারা চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, মাদক নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় তৈরি হয়েছে কিশোর গ্যাং। এদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক মাসে স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।গ্যাং সদস্যরা সামাজিক অস্থিরতা তৈরির পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত শনিবারও বন্দর উপজেলায় একরাতে দু’টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পেছনের দ্বন্দ্বের একটি কারণÑ এই মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও ইজিবাইক স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি নিয়ে বিএনপি সমর্থকদের দু’টি গ্রুপের দ্বন্দ্বে একজন দিনমজুর এবং একজন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিহত হন। এই ঘটনাতেও স্থানীয় কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশের একাধিক সূত্র।
স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ২৩ মে রাতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তর্কের জেরে কিশোর গ্যাং-এর হামলায় নিহত হন ১৬ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ খান রায়হান। সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ কদমতলী ডিএনডি লেকপাড় এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
এই ঘটনার বিষয়ে কথা হলে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিনোদন স্পটে পরিণত হওয়া সিদ্ধিরগঞ্জের ডিএনডি লেকটি সন্ধ্যার পর কিশোর গ্যাং সদস্যদের আড্ডাস্থল হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় সময়ই মারামারির ঘটনা ঘটে এখানে।
যদিও রায়হান হত্যাকাণ্ডে বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। যাদের মধ্যে অধিকাংশই কিশোর গ্যাং-এর সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর ফতুল্লার মাসদাইর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘ডি কোম্পানি’ নামে কিশোর গ্যাং-এর দুই সদস্যকে বিপুল পরিমাণ মাদক ও ধারালো অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এর আগে ৩ মে সিদ্ধিরগঞ্জের লাকি বাজার এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ইয়াছিন নামে ১৬ বছর বয়সী আরেক তরুণ মারা যান। স্থানীয়রা জানান, ওইদিন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা হয়। যা পরে সংঘর্ষে রূপ নেয় এবং প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে মারা যান ইয়াছিন।
এর আগে ডিসেম্বরে কিশোর গ্যাং-এর হামলায় আহত হন ফারুক নামে এক পোশাক শ্রমিক। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় র্যাব কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। মাদক মিলছে সহজে
ঢাকার লাগোয়া জেলা নারায়ণগঞ্জ।
ভোটার তালিকায় যাই থাকুক না কেন শিল্পঞ্চল খ্যাত এই নারায়ণগঞ্জ জেলায় রয়েছে এক কোটি মানুষের বসবাস। ঘনবসতিপূর্ণ এই জেলার পাশে কোনো সীমান্ত না থাকলেও সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধভাবে আসা মাদকের পরিবহন-ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে নারায়ণগঞ্জ শহর ও আশেপাশের এলাকায় খুব সহজেই পৌঁছে যায় মাদক।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র বলছে, সাধারণত কক্সবাজার, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের বিভিন্ন বর্ডার এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জে মাদকের পরিবহন হয়। এ দুই মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশিচৌকি থাকলেও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অভিনব কৌশলে মাদক পৌঁছে যায় এক হাত হয়ে অন্য হাতে। মাদক চোরা-কারবারিরা এক্ষেত্রে নদীপথকেও বেছে নেয়। নদীপথেও বিভিন্ন স্থানে পরিবহন হচ্ছে মাদক। যা পরবর্তীতে কিশোর-তরুণদের হাতে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ শহর ছাড়িয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারের বন্দর উপজেলারও চিহ্নিত কয়েকটি পয়েন্টে মাদক বিক্রি চলছে নিয়মিত। এবং রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র, যেটি স্থানীয়ভাবে ‘চনপাড়া বস্তি’ নামে পরিচিত, তাও মাদক ও সন্ত্রাসের ‘স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে কুখ্যাত।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আগে এসব জায়গায় মাদক খোলা ঘরে ছাপড়া বানিয়ে বিক্রি হতো। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বেড়েছে বলে খোলামেলা বিক্রি কিছুটা কমলেও, ব্যবসা একেবারে থেমে যায়নি। বরং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীরা নিজের ঘরে মজুদ রেখে গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে এই অবৈধ বাণিজ্য।
চনপাড়ায় এখনো ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা সহজেই পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে কিছু মাদক উদ্ধার ও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেও, চক্র ভেঙে পড়েনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় একাধিক সূত্র। বরং মাদক ব্যবসায়ীরা বরাবরই রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, বিশেষ করে চলতি বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্থিরতায় মাদকের বিস্তার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পুরনো মাদক ব্যবসায়ী চক্রগুলো আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
তবে, জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার একাধিক সময়ে বলেছেন, মাদকের ব্যাপারে জেলা পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ ভূমিকায়। মাদকের চিহ্নিত কয়েকটি স্পটে ইতোমধ্যে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধারও করা হয়েছে। মাদক নির্মূলে প্রতিনিয়ত কাজ করছে পুলিশ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, শহরের চাঁদমারী, টানবাজার সুইপার কলোনী, বন্দরের সুইপার কলোনী, একরামপুর, মদনপুর ও ফতুল্লার কয়েকটি স্থানে ইতোমধ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযান চালানো হয়েছে। এসব জায়গা থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক, দেশীয় তৈরি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এমনকি মাদকের ‘হটস্পট’ হিসেবে পরিচিত চনপাড়াতেও নিয়মিত অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে, নারায়ণগঞ্জবাসী বলছেন, মাদক ও কিশোর গ্যাং নির্মূলে প্রশাসনের ভূমিকা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক প্রশ্রয় বন্ধেরও দাবি জানান তারা।