আশা-হান্নানের দ্বন্দ্বে তিন ঘন্টায় জোড়া খুন

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

বন্দরে বিএনপি নেতা আশা-হান্নানের দ্বন্দ্বে তিন ঘন্টায় জোড়া খুন
বন্দরে পূর্ব শত্রুতায় আধিপত্য বিস্তার, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক স্ট্যান্ড, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশা অনুসারী ও প্রতিপক্ষ মহানগর বিএনপির বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকার অনুসারীদের মধ্যে টানা ৩ দিন যাবৎ দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে মারা গেছেন আব্দুল কুদ্দুস (৬০)।
যিনি আশা গ্রুপের ঘনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একই ঘটনায় একই দিনে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদী (৩৮) কে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। যিনি হান্নান সরকারের ঘনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পরিচিত।
গত শনিবার (২১ জুন) রাতে উপজেলার হাজারীবাগ ও সিরাজুদ্দৌলার ক্লাব মাঠের সামনে এ দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অন্তত আরও ৮ জন আহত হয়েছেন। একজন সি এম এইচ হাসপাতাল ও অপর একজন ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বন্দরে আধিপত্য বিস্তার ও ব্যাটারিচালিত স্ট্যান্ড দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, বৌ-বাজারের দোকান নিয়ন্ত্রণ, বালুর ড্রেজার এই সব নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে মহানগর বিএনপির বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকারের অনুসারী স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদী বাবু এবং মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিল আবুল কাউসার আশার অনুসারী জাফর রনির মধ্যে বিরোধ চলছিল।
কয়েকদিন আগে চুরির টিন বিক্রির টাকা নিয়ে মুখোমুখি যে ঘটনা আরো ২ মাস পূর্বের। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার রাত ১২ টায় চুরির টাকার ভাগ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে তর্কবিতর্ক ও অস্ত্রের মহড়াও চলে। পরবর্তীতে শুক্রবার বিকেলে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে দেশীয় অস্ত্রসহ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এরই জেরে গত শনিবার রাত ৯টার দিকে উভয় পক্ষের লোকজন মুখোমুখি হলে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আব্দুল কুদ্দুসকে কুপিয়ে আহত করে হান্নানের অনুসারীরা। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। কুদ্দুসের মৃত্যুর পর পুরো এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
নিহতের বিক্ষুব্দ স্বজনরা মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কও অবরোধ করে। অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়। কিন্তু ওই রাতেই সাড়ে ১১ টায় হান্নান সরকারের বাড়িসহ কয়েকটি দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়। পরে সিরাজুদ্দৌলার ক্লাব মাঠের সামনে তার সমর্থক স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদীকে বেধর পিটিয়ে আহত করে আশার সমর্থকেরা। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা মেহেদীকে উদ্ধার করে শহরের ৩শ’ শয্যা বিশিষ্ট খানপুর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। দফায় দফায় ঘটে যাওয়া এই সংঘর্ষ ও হত্যার পরপর এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সূত্র জানিয়েছেন, সংঘর্ষের একপক্ষে ছিলেন রনি ও জাফর অপর পক্ষে মেহেদী হাসান, বাবু সিকদার, বাবু ওরফে ‘জুয়ারি বাবু’ ও শ্যামল যারা বিগত দিন থেকেই আবুল কাউসার আশার অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এটা আশা তার বক্তব্যে প্রমান ও দিয়েছে। কিন্তু আশা ও হান্নানের ভিতরগত দ্বন্দ্বে মেহেদী হাসান, বাবু সিকদার, বাবু ওরফে ‘জুয়ারি বাবু’ ও শ্যামলকে নিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে নয়া গ্রুপ তৈরি করেন বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকার। যাকে ঘিরে এরা আশার কোন কার্যক্রমে আর দেখা যায়নি তার ঘনিষ্ট মেহেদী গ্রুপের কাউকে।
যাকে ঘিরে মেহেদীসহ পুরো গ্রুপের উপর সাবেক কাউন্সিলর আশার ব্যাক্তিগত একটি আক্রোশ ছিলো বলে জানিয়েছে সূত্র। এ ছাড়া বর্তমানে বন্দর থানা ও বন্দর উপজেলার বড় বড় মিল ফ্যাক্টরীসহ বিভিন্ন স্ট্যান্ডে সাবেক কাউন্সিলর আশার হাত রয়েছে।
একই সাথে আশার চাচা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপির বহিস্কৃত নেতা আতাউর রহমান মুকুলের কর্মী এই বহিস্কৃত হান্নান সরকার। সেই সুবাধে মুকুল বন্দরের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ হান্নান সরকারের মাধ্যমে করে থাকে।হান্নানের এই দখল-দারিত্বের মধ্যে ও মুকুলের নির্দেশ থাকতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।যাকে ঘিরে এই সংঘর্ষ ও হত্যার মাধ্যমে আশা ও মুকুলের বিরোধ প্রায় প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে।
দফায় দফায় সংঘের্ষর নিহত কুদ্দুসের ছোট ভাই দুদু মিয়া বলেন, আমার বড় ভাই চায়ের দোকানে ছিলো। ভাইকে ডাইকা নিয়া তার ছেলে পারভেজ কই জানতে চায়। পরে তারা ভাইরে এলোপাথারি ছুরি দিয়া আঘাত করে। ভাই নাকি বারবার তা গোরে কইছে, আমারে জানে মাইরো না। কিন্তু কিছু শোনে নাই হামলাকারীরা। আমরা লাশ গিয়া পাইছি হাসপাতালে।
নিহত মেহেদীর ভগ্নিপতি মাহফুজুল হক সৌরভ জানান, বন্দরে যখন কুদ্দুস হত্যা হয় তখন মেহেদী ছিল বাড়িতে ও থাকতো অন্তত এক কিলোমিটার দূরে আমিন আবাসিক এলাকায়। হত্যার পর প্রতিপক্ষের লোকজনকে খুঁজতে গেলে রাস্তায় মেহেদীকে তুইল্লা নিয়া সিরাজউদ্দোল্লা ক্লাবে নিয়ে বেধরক মারে।বুকে, মাথা আর মুখমন্ডল একেবারে থেতলে দিছে আমরা চেহারা ও ভালো মতো চিনা যায় না।
সংঘর্ষের ঘটনার বিষয়ে বন্দর থানার এসআই শহিদুল ইসলাম জানান, দফায় দফায় সংঘর্ষে নিহত কুদ্দুস ও মেহেদীর মরদেহ উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ সদর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানোর পর তাদের দাফন সম্পূর্ণ হয়েছে। উভয়পক্ষের আহত আরও অন্তত ৮ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পুরো ঘটনাই পূর্ব শত্রুতার জেরে আধিপত্য ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ নিয়েই। কিন্তু গত ৩ দিন যাবৎ সংঘর্ষে আমরা এসে যারা শুনতে পেয়েছি গত ২ মাস পূর্বে তাদের মধ্যে চুরি নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে সেই সমস্যা ভাগাভাগির টাকায় রূপ নেয় ৪০০-৫০০ টাকা ভাগাভাগি নিয়ে প্রথমে তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। পরবর্তীতে সেই তর্ক আধিপত্যেকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায়। গত ৩ দিন যাবৎ দফায় দফায় হওয়া সংঘর্ষে আমরা এটাই জানতে পেয়েছি।
দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের শেষে জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেছেন, “স্থানীয়ভাবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড দু’টি ঘটেছে। এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে এবং যারা নেপথ্যে আছেন, তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।”
তিনি বলেন, এই ঘটনায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যেই র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে অন্তত তিনজনকে আটক করা হয়েছে।
সর্বশেষ গতকাল রাত ১২ টায় বন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ লিয়াকত আলী বলেন, দফায় দফায় সংঘর্ষে ঘটনায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দ্রুতই দুই হত্যায় দুটি মামলা দায়ের করবে নিহতের স্বজনরা।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশা বলেন, রনি ও মেহেদী দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সাথে ছাত্র রাজনীতি করতেন। ওরা ছাত্র দল থেকে স্বেচ্ছাসেবক দল করতেন আমাদের সাথে। অটো রিকশার স্ট্যান্ড নিয়ে যে ঘটনাটি, সেটি দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে চলছে।
এটা অনেক বার আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছু মানুষের কারনে সমাধান করতে পারিনি। তারা বরংচ উস্কানি দিয়ে দেয়। তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি যেই এলাকায় ঘটেছে সেটি আমার এলাকা না। যেই দুইটি গ্রুপ এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা হান্নান সরকারের লোক। হান্নান সরকারকে ওরা মানে, শ্রদ্ধা করে। হান্নান সরকারের মাধ্যমেই একটা সময় ওরা আমাদের এখানে এসেছে। এরপর থেকেই ওরা আমাদের সাথে ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবকদলের রাজনীতি করতেন। কুদ্দুস মিয়া নামে যে একজন ভদ্রলোক খুন হয়েছে তাকে আমি তেমনভাবে চিনি না।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকারের সাথে যোগাযোগ করলে তার ব্যবহিত ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।