পিআরে অটল জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন, মানছে না বিএনপি

যৃুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

পিআরে অটল জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন, মানছে না বিএনপি
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি নিয়ে চলছে তোলপাড়। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বাড়ছে আলোচনা-সমালোচনা। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি করলেও ঘোর বিরোধিতা করছে বিএনপি। এ কারণে ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভিন্ন মত দিচ্ছে। ফলে ভোট নিয়ে এক ধরনের শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। কারণ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ মিত্ররা পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল এই পদ্ধতিতেই ভোটের পক্ষে অটল থাকায় পিআর পদ্ধতি নিয়ে তৎপরতাকে নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখছে বিএনপি। যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা ছাড়া বর্তমানে পিআর পদ্ধতি নিয়ে কঠোর হচ্ছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। গতকাল শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয় ঘোষিত পাঁচ দফা দাবির পক্ষে নারায়ণগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নারায়ণগঞ্জ মহানগর শাখা। দলটির দাবিগুলো হলো- পিআর পদ্ধতি চালু করা, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ১৪ দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। একই দিনে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৫ দফা দাবিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নারায়ণগঞ্জ মহানগরের উদ্যোগে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে ইসলামী আন্দোলনের মতো একই দাবি উপস্থাপন করা হয়। তা ছাড়া দুই দলের দাবির মধ্যেই সর্ব প্রথম ও প্রধান দাবি আগামী নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে চাই। এমন পরিস্থিতিতে উভয়পক্ষ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে কাছে টানা এবং নিজেদের অবস্থানের দিকে জনমত তৈরির চেষ্টা করছে। তা ছাড়া বর্তমানে ফেব্রুয়ারিতেই ভোট করতে হলে হাতে থাকা সময়ের মধ্যে পিআর পদ্ধতিতে যাওয়ার বাস্তবতা আর আছে কি না, সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। আর, এমন প্রেক্ষাপটে পিআর এর দাবিতে মাঠে নামা দলগুলোকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জামায়াত ইসলামী।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, ক্ষমতার ভাগাভাগিসহ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে সরকার কিংবা অন্য কারও ওপর চাপ তৈরির জন্যই ‘পিআর পদ্ধতিতে’ নির্বাচনের দাবিটি সামনে আনা হয়ে থাকতে পারে। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, নির্বাচন বিলম্বিত করার ‘ষড়যন্ত্র ও কৌশল’ হিসাবেই এসব ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে। মানুষ ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং সেই প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। সেই ভোটই মানুষ দেখতে চায়।
এদিকে পিআর পদ্ধতি নির্বাচনের বিপক্ষে তা প্রত্যাখান করে সাবেক সাংসদ আলহাজ¦ মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেছিলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। পিআর পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে সেই নতুন ষড়যন্ত্রের ফাঁদ। একটা দল ৫ আগস্টের পরে মনে করেছিলো তারা ক্ষমতায় চলে এসেছে কিন্তু যতো দিন যাচ্ছে ততই তারা বুঝতে পারতেছে ভোটের মাঠে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই তারা পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার জন্য এই নতুন নাটক সাজিয়েছে। কিন্তু বাংলার মানুষ নির্বাচন নিয়ে আর কোনো ষড়যন্ত্র হতে দেবে না। আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবো।
তিনি বলেছিলেন, যারা সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছেন তাদেরকে বলবো, এই সংস্থার কাজ আরো দুই বছর আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা ঘোষণার মাধ্যমেই শুরু করে দিয়েছিলেন। আপনারা যা ২০২৫ সালে করতে চাইছেন, তা আমাদের নেতা তারেক রহমান আরো দুই বছর আগেই শুরু করেছেন। ৫ আগস্টের পর গত এক বছরে অনেক সংস্কার হয়েছে। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতা পালিয়ে গিয়েছেন। যারা পালাতে পারেননি তাদের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা কর্মচারী শেখ হাসিনার দোসর ছিলো তাদেরকে চাকরীচ্যুত করা হয়েছে। নতুন অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। এখন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সে সকল সংস্কার কাজের গতিকে আরো ত্বরান্বিত করবে। তাই আমি বলবো নির্বাচন নিয়ে কোন তালবাহানা করবেন না।
তিনি আরো বলেছিলেন, গত জুলাই আগস্টে ৩৬ দিনের আন্দোলনে এদেশের মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছে কোনো স্বৈরাচারী সরকার আর এদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। কেউ যদি জোর করে ক্ষমতা দখল করতে চায় তাহলে তার পরিণতি সেই খুনি হাসিনা সরকারের চেয়েও ভয়াবহ হবে। তাই সবাই সতর্ক হয়ে যান। এদেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলবেন না। গত তিনটি নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে নাই। তিনটি অবৈধ নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার গ্রেফতার হয়েছেন এবং তারা স্বীকার করেছেন দিনের ভোট রাতে দেয়া হয়েছিলো। মানুষের ভোটের অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিলো। মানুষ তার পছন্দমত প্রার্থীকে ভোট দিতে চায়। পিআর পদ্ধতি কথা এদেশের মানুষ কখনো শোনেনি। এই নিয়ম সম্পর্কে এদেশের মানুষের কোন ধারণাই নেই। এই নিয়ম ইহুদী-খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলোতে চলমান আছে। আর বাংলাদেশ হচ্ছে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এখানকার মানুষ ধর্মভীরু। এখানে ইসলামী আইন-কানুন চালু না করে জোর করে নতুন কিছু চাপিয়ে দেয়া উচিত হবে না। এই সরকার প্রথমে বলেছিলো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেবে। পরে বলেছে ফেব্রুয়ারিতে দেবে। এখন যদি নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রকার ছলনার আশ্রয় নিয়ে অধিক সময় ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে তাহলে দেশের মানুষ আবার রাজপথে নামতে বাধ্য হবে। তাই সুষ্ঠ অবাধ নির্বাচন সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে। দেশের বাকি সংস্কারগুলো নির্বাচিত সরকার এসে সম্পাদন করবে।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়ার বিপক্ষে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এড. সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছিলেন, গত ৫ আগস্টের পর দেশে একটি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। তাদের দায়িত্ব হল দেশে একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু কিছু দল আছে যারা এর আগেও আমাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। তারা এখন আর নির্বাচন চায়না তারা চায় দুর্বল নির্বাচন। এই ইসলামী দলসহ কিছু দল গুলোর মাঠ পর্যায়ে ভোট নাই, তারা এখন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। কারন তারা যানে যদি ভোট হয় তাহলে তারা একটি সিটও পাবে না এবং ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তার জন্যই দেশের ৫৫ টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ ১৪টি দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়।
তিনি বলেছিলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা রাষ্ট্র মেরামতের ঘোষণা করেছেন। বিএনপি ক্ষমতা আসলে তিনি তা বাস্তবায়ন করবেন। আমাদের ভারপ্রাপ্ত তারেক রহমান বলেছেন আমরা ক্ষমতায় গেলে একলা দেশ শাসন করবো না। সব দলকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ পরিচালিত করা হবে। কিন্তু আমাদের সাথে থাকা কিছু দল এখন তার বিরোধিতা করছেন। আমাদের আন্দোল সংগ্রামকে তারা ভূলন্ঠিত করতে চায় এবং তারা জুলাই বিপ্লবের অর্জিত স্বাধীনতাকে কিলিং করতে চায়। জুলাই বিপ্লবের সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে ৫৫টি মামলা হয়েছে। সেই মামলায় আমাদের বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার ও নির্যাতন সহ্য করেছে। আর আপনারা কেউ কেউ একটি মামলা খেয়ে লাফালাফি করছেন। আর আজকে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিএনপির ষড়যন্ত্র করে কেউ পার পাবেন না। এদেশের মানুষ বিএনপির বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিবে। আমাদের নেতা তারেক রহমান শীগ্রই দেশে ফিরবেন। তখন দেখবেন দেশের ১০নাম্বার বিপদ সংকেতের মতন লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে এয়ার পোর্টে স্বাগতম জানাবে। সুতরাং যারা দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে যড়যন্ত্র করছেন আপনারা সাবধান হয়ে যান। সেই সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
এদিকে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য ‘বড় জয়’ ঠেকানোর জন্যই এসব করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হলে ফ্যাসিস্টরা সুযোগ পাবে বলেও জানান নেতারা। তা ছাড়া পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগবে। নতুন পদ্ধতির আলোচনা মূলত নির্বাচন বিলম্বিত বা বানচাল করার একটি কৌশল।
এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে নেতারা জানান, পিআর পদ্ধতিতে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে ভোটের শতকরা হিসাবে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। এ দেশে সবচেয়ে বড় দল রেকর্ড ভোট হয়তো ৪০ শতাংশ পেয়েছে। সেই হিসাবেও পিআর পদ্ধতিতে ৩০০ আসনের মধ্যে ১২০ আসন পাবে। তাহলে সরকার গঠন করতে পারবে না। এ রকম জটিল অবস্থায় কোয়ালিশন সরকার গঠন হবে এবং ঝুলন্ত সংসদ হবে। এতে কোনো সরকারই দেশ পরিচালনা করতে পারবে না। কিন্তু ওই সব ক্ষুদ্র দল বা যারা জনগণের কম প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের সুবিধা হবে। তারা যদি ১০ ভাগ ভোট পায়, তাহলে ৩০টি আসন পাবে। কেউ ৫ ভাগ পেলে তারা ১৫টি আসন পাবে। এখন এসব দলের প্ররোচনায় যদি পিআর পদ্ধতি চালু হয়, তাহলে বাংলাদেশে সব সময় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে।
গতকাল পিআর পদ্ধতি নিয়ে মহানগর জামায়াত আমীর মাওলানা আবদুল জব্বার বলেন, দেশের সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চায়। আর কোনো ভোট ডাকাতি জনগণ দেখতে চায় না। তিনি প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পি.আর.) পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানান। তিনি সতর্ক করে বলেন, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা জনগণ মেনে নেবে না। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা হলে তা জনগণ রুখে দাঁড়াবে।
পিআর পদ্ধতি নির্বাচন চেয়ে গতকাল ইসলামী আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, আমরা পিআর পদ্ধতিতেই নির্বাচন চাই তা হতে হবেই। “ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি সংগঠন। যদি কেউ মনে করেন এই সংগঠনকে মুছে ফেলবেন, তবে বুঝবো আপনারা বোকার রাজ্যে বাস করছেন। ইসলামী আন্দোলনের শক্তি কেমন, তা মানুষ জুলাই আন্দোলনে দেখেছে।”
তিনি আরো বলেন, “জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা আহত, শহীদ ও পঙ্গু হচ্ছিল। তখন আমাদের আমির বুক পেতে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত রাজপথে থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। ভবিষ্যতে যদি কোনো ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, তবে ইসলামী আন্দোলন কাউকেই ছাড় দেবে না। যদি আমাদের বাইরে রেখে নির্বাচন করা হয়, সেই নির্বাচন আমরা হতে দেব না। আমাদের এই পাঁচ দফা শুধু ইসলামী আন্দোলনের নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণের দাবি, স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব ও দেশের মানচিত্র রক্ষার দাবি।”