হান্নান-আশা বিএনপির কেউ নয় এরা বহিস্কৃত ও পদত্যাগকারী

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

হান্নান-আশা বিএনপির কেউ নয় এরা বহিস্কৃত ও পদত্যাগকারী
বন্দরে আধিপত্য বিস্তার, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশা অনুসারী ও প্রতিপক্ষ মহানগর বিএনপির বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকার অনুসারীদের মধ্যে টানা ৩ দিন যাবৎ দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে মারা গেছেন আব্দুল কুদ্দুস (৬০)। একই ঘটনায় দুই ঘন্টার ব্যবধানে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদী (৩৮) কে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এই দুই হত্যার ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুই মামলায় দুই সাবেক কাউন্সিলরসহ আসামী ১২৮ জন। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এমনকি এরা হুঁশিয়ারী দিয়ে বলে দিয়েছেন যে দুই গ্রুপের দুই নেতাকে বিএনপি পরিচয় দেওয়া হচ্ছে এরা একজন বহিস্কৃত আরেকজন পদত্যাগকারী এরা বিএনপির কেউ নয় বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত শনিবার (২১ জুন) রাতে উপজেলার হাজারীবাগ ও সিরাজুদ্দৌলার ক্লাব মাঠের সামনে এ দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অন্তত আরও ৮ জন আহত হয়েছেন। একজন সি এম এইচ হাসপাতাল ও অপর একজন ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বন্দরে আধিপত্য বিস্তার ও ব্যাটারিচালিত স্ট্যান্ড দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, বৌ-বাজারের দোকান নিয়ন্ত্রণ, বালুর ড্রেজার এই সব নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে মহানগর বিএনপির বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকারের অনুসারী স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদী বাবু এবং মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিল আবুল কাউসার আশার অনুসারী জাফর রনির মধ্যে বিরোধ চলছিল।
কয়েকদিন আগে চুরির টিন বিক্রির টাকা নিয়ে মুখোমুখি যে ঘটনা আরো ২ মাস পূর্বের। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার রাত ১২ টায় চুরির টাকার ভাগ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে তর্কবিতর্ক ও অস্ত্রের মহড়াও চলে। পরবর্তীতে শুক্রবার বিকেলে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে দেশীয় অস্ত্রসহ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এরই জেরে গত শনিবার রাত ৯টার দিকে উভয় পক্ষের লোকজন মুখোমুখি হলে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
একপর্যায়ে আব্দুল কুদ্দুসকে কুপিয়ে আহত করে হান্নানের অনুসারীরা। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। কুদ্দুসের মৃত্যুর পর পুরো এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিহতের বিক্ষুব্দ স্বজনরা মদনপুর-মদনগঞ্জ সড়কও অবরোধ করে। অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়। কিন্তু ওই রাতেই সাড়ে ১১ টায় হান্নান সরকারের বাড়িসহ কয়েকটি দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়।
পরে সিরাজুদ্দৌলার ক্লাব মাঠের সামনে তার সমর্থক স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদীকে বেধর পিটিয়ে আহত করে আশার সমর্থকেরা। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা মেহেদীকে উদ্ধার করে শহরের ৩শ’ শয্যা বিশিষ্ট খানপুর হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। দফায় দফায় ঘটে যাওয়া এই সংঘর্ষ ও হত্যার পরপর এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সূত্র জানিয়েছেন, সংঘর্ষের একপক্ষে ছিলেন রনি ও জাফর অপর পক্ষে মেহেদী হাসান, বাবু সিকদার, বাবু ওরফে ‘জুয়ারি বাবু’ ও শ্যামল যারা বিগত দিন থেকেই আবুল কাউসার আশার অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এটা আশা তার বক্তব্যে প্রমান ও দিয়েছে। কিন্তু আশা ও হান্নানের ভিতরগত দ্বন্দ্বে মেহেদী হাসান, বাবু সিকদার, বাবু ওরফে ‘জুয়ারি বাবু’ ও শ্যামলকে নিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে নয়া গ্রুপ তৈরি করেন বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকার।
যাকে ঘিরে এরা আশার কোন কার্যক্রমে আর দেখা যায়নি তার ঘনিষ্ট মেহেদী গ্রুপের কাউকে। যাকে ঘিরে মেহেদীসহ পুরো গ্রুপের উপর সাবেক কাউন্সিলর আশার ব্যাক্তিগত একটি আক্রোশ ছিলো বলে জানিয়েছে সূত্র। এ ছাড়া বর্তমানে বন্দর থানা ও বন্দর উপজেলার বড় বড় মিল ফ্যাক্টরীসহ বিভিন্ন স্ট্যান্ডে সাবেক কাউন্সিলর আশার হাত রয়েছে।
একই সাথে আশার চাচা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপির বহিস্কৃত নেতা আতাউর রহমান মুকুলের কর্মী এই বহিস্কৃত হান্নান সরকার। সেই সুবাধে মুকুল বন্দরের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ হান্নান সরকারের মাধ্যমে করে থাকে। হান্নানের এই দখল-দারিত্বের মধ্যে ও মুকুলের নির্দেশ থাকতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।
যাকে ঘিরে এই সংঘর্ষ ও হত্যার মাধ্যমে আশা ও মুকুলের বিরোধ প্রায় প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। যা গত ৫ আগষ্টের পর থেকেই আশা ও মুকুল গ্রুপ বার বার ফুঁসে উঠছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জোড়া খুনে আলোচনায় বন্দর। এদিকে এ ঘটনায় দুই গ্রুপকে বিএনপি নেতা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিউজ প্রকাশিত হলে ও মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতারা হান্নান ও আশাকে বিএনপি নেতা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, এরা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী হিসেবেই বিগত দিনে কাজ করে বিএনপি থেকে দূরে থেকেছেন তাহলে এখন কেন অপকর্ম করে এখানে বিএনপির নাম জড়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এড. সাখাওয়াত হোসেন খান যুগের চিন্তাকে বলেন, আমরা চাই নারায়ণগঞ্জ একটি শান্তির নারায়ণগঞ্জ থাকুক, কোন অপরাধের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনা সংগঠিত হোক আমরা সেটা চাই না। কিন্তু বন্দরে দুই গ্রুপের যে ঘটনাটি ঘটেছে এর মাধ্যমে আমরা ব্যাথিত হয়েছি, বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এ ছাড়া প্রশাসনের প্রতি আবেদন থাকবে যে দোষী তার বিরুদ্ধে অতিদ্রুত প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আর যদি প্রশাসন দোষিদের আইনের আওতায় না আনে তাহলে এই ধরনের অপকর্ম দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়া ও পত্রপত্রিকায় দেখলাম যে দুই গ্রুপের দুইজনকে বিএনপি নেতা বানিয়ে নিউজ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমি বলতে চাই এখানে বিএনপি নেতা যে হান্নান সরকারের কথা বলা হয়েছে তিনি আরো কয়েক বছর আগেই বিএনপি থেকে তার কুকর্মে বহিস্কার হয়েছে এখন সে বিএনপির কেউ নয়। তার অপকর্মের দায় বিএনপি নিবে না। আর আরেকটি গ্রুপের প্রধান আবুল কাউসার আশা যিনি গত সরকারের আমলে জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর সে সরকারের সাথে একাকার হয়ে গিয়েছিলো যাকে ঘিরে ২০২২ সালে তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন যার কারণে বর্তমানে তিনি বিএনপির কোন পদের সাথে বা বিএনপির সাথে নয়।কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় তিনি বিএনপির পদধারী নেতা হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দলের নীতি কোন অপরাধীকে দল পশ্রয় দিবে না।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু যুগের চিন্তাকে বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে দুইজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছে। এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। পাশাপাশি ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জের বন্দরে ঘটনাটি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও উদ্বেগজনক। এমন ঘটনার নৈপথ্যে যারা তারা এই কিশোরগ্যাংদের লালন-পালন করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে স্ট্যান্ড ও মাদক ব্যবসা পরিচালনা করান।
আর এখানে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দুই গ্রুপের যাদের কথা বলা হয় তারা একজন বিগত ১৬ বছর সরকারি দলের পক্ষে কাজ করায় মহানগর বিএনপি থেকে তাকে বহিস্কার করা হয় সেই নেতা হান্নান সরকার আরেকজন মহানগর বিএনপির পদত্যাকারী যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাউসার আশা যিনি মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটি থেকে নিজেই পদত্যাগ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি বিএনপি নয়।
তিনি বলেন, যারা বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন তারা বিএনপির কেউ নয়। আর যারা এই সংঘর্ষ পরিচালনায় ছিলো এদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন বিএনপির যত বড় নেতাই অপকর্ম করবে তাকে আইনের আওতায় দেওয়া দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে বন্দরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের বিরোধে দুই হত্যার ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত রোববার (২২ জুন) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে নিহতের মেয়ে রোখসানা আক্তার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা এবং মেহেদী হাসান হত্যার ঘটনায় গতকাল সোমবার (২৩ জুন) দুপুরে তার ভাই খালেদ সাইফুল্লাহ বাদী হয়ে অপর একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এদিকে কুদ্দুস হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে।
মামলা দায়েরের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম জানান, রাজমিন্ত্রী আব্দুল কুদ্দুস হত্যা মামলায় সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকারকে হুকুমের আসামি করে বাবু ওরফে জুয়াড়ি বাবুসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৩০ জনকে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নিহতের মেয়ে রোখসানা আক্তার। এই মামলায় শাকিল ও জজ মিয়া নামের দুই আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মেহেদী হত্যার হত্যার ঘটনায় ২৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৪০ জনকে আসামী করা হয়েছে।