Logo
Logo
×

রাজনীতি

বায়তুল আমানে ভাঙচুর কী পাতানো খেলা !

Icon

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

বায়তুল আমানে ভাঙচুর কী পাতানো খেলা !
Swapno

 গতবছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার পতনের সাথে সাথে পতন ঘটে ওসমান সাম্রাজ্যের। ওসমান সাম্রাজ্যের দুই জীবিত প্রতিনিধি জাতীয় পার্টি নেতা ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান, আওয়ামী লীগ নেতা ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান দুইজনই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান। সেই সাথে পালিয়ে যান গত ১৭ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জবাসীর উপর জুলুম, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, দস্যুতা, হত্যা, ডাকাতিসহ নানা অপকর্মের ওসমানীয় দোসররা।

নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে ওসমান সাম্রাজ্য ছিল যেমন আতঙ্কের নাম, তেমনি তীব্র ঘৃণা ছিল মানুষের অন্তরে অন্তরে। আর সেই কারণে ৫ আগস্টের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জামতলায় শামীম ওসমানের বাড়ি,  উত্তর চাষাঢ়ায় তার পৈত্রিক বাড়ি হীরা মহলে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এসময় চাষাঢ়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলী যে বাড়িতে থাকতেন সেই বায়তুল আমানে কেউ হামলা চালায়নি কিংবা লুটপাটও করেনি। তাহলে ঘটনার ছয় মাস পর ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কেন বায়তুল আমানে হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হল, আর কারাই বা এই হামলার নেপথ্যে ছিল? কী বা ছিল এর উদ্দেশ্য, সে এক অপার রহস্য!

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডটি সম্প্রসারণ করার জন্য যেখানে সরকারিভাবে আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল চাষাঢ়ার মোড়ে অবস্থিত বায়তুল আমান ভবন এবং রাইফেল ক্লাব ভবন দুটি ভেঙে ফেলা হবে, সেখানে কেনই বা আগেভাগে বায়তুল আমান গুঁড়িয়ে দিয়ে কোন গোষ্ঠীকে ফায়দা লুটার সযোগ দেয়া হল? এরআগে ২০০১ সালে বাড়িটি ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তখন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী বাধা হয়ে দাঁড়ান ভবনটি ভাঙার ব্যাপারে।

নারায়ণগঞ্জবাসী জানে, শামীম ওসমানসহ তাঁরা তিন ভাই এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা কীভাবে মানুষের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। বায়তুল আমানে যারা বসবাস করতেন, তারা ছিলেন শামীম ওসমানের বাবা একেএম শামসুজ্জোহার ভাইয়েরা। শামসুজ্জোহা পরিবারের সাথে তার সৎ ভাই সারোয়ার পরিবারের ননী ও মনি সারোয়ারের পারিবারিকবাবে কোন সম্পৃক্ততাই ছিলনা। এমনকি শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান কিংবা নাসিম ওসমানের পারিবারিক অনুষ্ঠানে তার চাচাদের পরিবারের সদস্যদের দেখা পাওয়া ছিল খুবই দুর্লভ চিত্র। বরং শামীম ওসমান এবং তার ভাইদের হাতে তার চাচার পরিবাওে সদস্যরা বিভিন্ন সময় লাঞ্ছিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শামীম ওসমানের আসন হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান শামীম ওসমানের চাচা শফিউদ্দিন সারায়োর ওরফে বাবু সারোয়ারের সাবেক স্ত্রী প্রয়াত চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী। ওই সময় ৫ বছর এই আসনের প্রতিনিধিত্ব করলেও এক মুহুর্তের জন্য শামীম ওসমান ও তার ভাইয়েরা তাকে শান্তিতে কাজ করতে দেননি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভায় দেখা গেছে,শামীম ওসমান প্রকাশ্যেই তার চাচী সারাহ বেগম কবরীকে লাঞ্ছিত করেন। কবরীর স্বাভাবিক কাজকর্ম যাতে বিঘ্নিত হয় এ কারণে শামীম ওসমান তাঁর ক্যাডার বাহিনীকে তার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। ওই সময় চাচাদের সাথে শামীম ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়ের সাপে-নেউলে সম্পর্ক দেখেছেন নারায়ণগঞ্জবাসী।

শামসুজ্জোহার উত্তরসূরীরা নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে এক দানবীয় সত্ত্বার মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিলেন, এখনো আছেন। সেখানে শামসুজ্জোহার ভাইদের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীদের কখনোই কোন ক্ষোভ ছিল না।

চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা দ্বিতীয়বারের মতো হানা দিয়ে বাড়িটি ভেঙে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে। খুলনায় শেখ হেলালের বাড়ি, নোয়াখালিতে ওবায়দুল কাদেরর বাড়ি, কুষ্টিয়ায় হানিফের বাড়ি ভাঙচুর, বরিশালের আমির হোসেন আমুর বাড়ি, কিশোরগঞ্জে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বাড়ি, ভোলায় তোফায়েল আহমেদের বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু ভারতের কলকাতার রিপাবলিক বাংলা চ্যানেলের কমেডিয়ান উপস্থাপক ময়ুখ রঞ্জন ঘোষ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির পাশাপাশি এরএকদিন পর গুঁড়িয়ে দেয়া শামীম ওসমানের দাদার বাড়ি বায়তুল আমান ভাঙচুরের বিষয়টি ফলাও করে আলোচনায় টেনে আনেন। এতে হাইলাইটস করার হয়েছে শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যদের। অথচ এই বাড়িটির সাথে শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সাথে কোন কালেই সম্পৃক্ততা ছিলনা। তারা কখনো পরিচয়ই দিতো না তাদের পূর্বপুরুষ খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়ি ছিল এটি। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে, শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি বিশেষ কোন সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যে অথবা তারা যে নির্যাতিত এবিষয়টি ফুটিয়ে তোলার জন্যই কী কোন বিশেষ মহলের ইন্ধনে কোন কারণ ছাড়াই বায়তুল আমান গুঁড়িয়ে দেয়া হল?

অনুসন্ধানে জানা গেছে,  বায়তুল আমান ভাঙচুরের নেপথ্যে যারা জড়িত তাদের অনেকের সাথেই শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে গভীর সখ্যতা ছিল এবং তা এখনো রয়েছে। ওসমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও ওসমান দোসররা এখনো নারায়ণগঞ্জে সক্রিয়, বিভিন্ন সংগঠনে ছদ্মাবরণ করে তারা এখনো অবস্থান করছেন। শামীম ওসমান- সেলিম ওসমান যাই নির্দেশ করেন তাই তারা এখনো পালন করে চলেছেন।

সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহবায়ক, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির উপদেষ্টা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আসলে এখন বিভিন্ন খেলায় কাজ করছে বিভিন্ন চক্র। রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য বায়তুল আমান ও রাইফেল ক্লাব অপসারণের দাবিটি ছিল দীর্ঘদিনের, এটি সরকারিভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্য রাজনীতিটি কী করে ঢুকে পড়লো সেটি একটি দেখার বিষয়। ওপাড় বাংলায় ফলাও করে হলুদ সাংবাদিতায় আবোল-তাবোল বকেই যাচ্ছে। আমরা যে শুধু এই দুটি ভবন সরিয়ে নেয়ার দাবি তুলেছি তা নয়, আমরা পুরাতন সড়কের পাশে ডাকবাংলো এবং পুলিশ ফাঁড়ি অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছি। এগুলো এখান থেকে অপসারণ করলে নারায়ণগঞ্জবাসী যানজটের এই ভয়াল সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে।’

জামায়াতে ইসলামী নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মাওলানা আবদুল জব্বার যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যের কারণে বায়তুল আমান ভাঙার পেছনে তাদের হাত থাকার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতে আপত্তি নেই। তবে এখানে শামীম ওসমানের লোক হোক আর যারাই হোক এভাবে ভেঙে দেয়াটি ঠিক হয়নি, এতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। রাস্তা প্রশস্তকরণের কারণে প্রশাসন এমনিতেই এবিষয়ে উদ্যোগ নিতো। তবে আরেকটি বিষয়ও এখানে কাজ করে থাকতে পাওে, দীর্ঘদিন ওসমানদের শোষণ-নিপীড়নের কারণে মানুষের মনে ক্ষোভ দান বেধেছে, কোন কোন পক্ষের ক্ষোভ থেকেও এমনটি হয়ে থাকতে পারে। তবে যে কারণেই ঘটুক, এটাকে পুঁজি করে অন্যরা ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। এই ভবনের চর্তুদিকেই সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে, সেখানে ফুটেজও পাওয়া যেতে পাওে, সেসকল ভিডিও প্রশাসনের যাঁচাই করে দেখা উচিৎ। প্রশাসন থাকতে আমরা আইন হাতে তুলে নিতে পারিনা। প্রশাসনেরই খতিয়ে দেখা উচিৎ পুরো বিষয়টি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক নিরব রায়হান বলেন, ‘আমান ভবন ভাঙচুরের বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে আমাদের বৈষম্যবিরোধী কমিটির পক্ষ থেকে কেউ এটা করেনি।’

নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘বিএনপির কেউ ভবন ভাঙচুর করেনি। এটা কারা করেছে তা জানা নেই।’

তবে বায়তুল আমান ভবন গুঁড়িয়ে দেয়ার দিন ঘটনাস্থলে থাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু সাংবাদিকদের বলেন, ‘খুনি হাসিনা ও তার ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বছরের পর বছর মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী অসংখ্য গুম, খুন করেছে। ওসমান বাহিনীর প্রতি মানুষের যে ক্ষোভ, তা এই ভবনটি ভাঙার মধ্য দিয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া চাষাড়া মোড় বড় করার জন্য নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির নেতারা ও নগরবাসী বায়তুল আমান ও রাইফেল ক্লাব ভাঙার দাবি জানিয়ে আসছে।’

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন