না.গঞ্জ আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ফিরেছে সেই পুরনো জৌলুস

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

না.গঞ্জ আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ফিরেছে সেই পুরনো জৌলুস
নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির নির্বাচন মানেই ছিল একমাস ব্যাপী বিরাট আয়োজন। খাওয়া-দাওয়া, কুশল বিনিময়, আইনজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রার্থীদের ভোট প্রার্থনা, আইনজীবীদের সাথে নির্বাচনী বিষয়ে নানা মত-দ্বিমত, আড্ডা আরও কত কি? তবে এসব কিছু গত ৭/৮ বছর ধরে এক প্রকার হারিয়েই গিয়েছিলো এসব আয়োজন। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নিপীড়ন আর কুখ্যাত ওসমান পরিবারের নগ্ন হস্তক্ষেপে আইনজীবীদের এই নির্বাচন বিগত সময়ে এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠে।
নির্বাচন আসলেই শামীম ওসমানের নির্দেশে কুখ্যাত ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ তার ক্যাডারবাহিনীরা আইনজীবীদের ভয় দেখাতে আদালতপাড়ায় মহড়া দিতো। এছাড়া শামীম ওসমানের লেজুরবৃত্তি করা বেশ কিছু আইনজীবীই আইনজীবীদের দমন-নিপীড়নে উঠেপড়ে লেগে পড়তো। অনর্থক আইনজীবীদের হেনস্থা করা, আইনজীবীদের মারধর, নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি, নির্বাচনের নামে সিলেকশন কমিটি, বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবী প্রার্থীদের উপর নানা দমন নিপীড়ন, এমনকি ওসমানদের ভিন্নমতের আইনজীবীদের উপর নেমে আসতো নানা অত্যাচারের খড়গ।
নির্বাচনে আইনজীবী প্রার্থীদের অস্ত্র প্রদর্শন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারের সদস্যদের হুমকি-ধমকি, ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন, আইনজীবীদের চেম্বারে ঢুকে মারধর, সাংবাদিকদের নাজেহাল, মারধর কোন অত্যাচারই বাদ রাখেনি ওসমানীয় সন্ত্রাসীরা। ওসমানদের আজ্ঞাবহ কুখ্যাত খালেদ হায়দার খান কাজলের থাবা থেকে মুক্ত হওয়ার পর এবারই প্রথম পুরনো সেই জৌলুসে ফিরে গিয়ে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতি। শামীম ওসমানে ছায়ায় আইনজীবীদের উপর স্বেচ্ছাচারিতা চাপিয়ে দেয়া নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সাবেক দুই সভাপতি এড. হাসান ফেরদৌস জুয়েল এবং মোহসীন মিয়া দুইজনই আজ পলাতক। পলাত আরো অনেক কুর্কীর্তিতে অংশ নেয়া আওয়ামী পন্থী আইনজীবী। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা।
তার পালানোর খবরে আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতারাই এখন পলাতক। তাদের অধ্যায় শেষ হলেও এবারের জাকজমকপূর্ণ নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির (২০২৫-২০২৬) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আলোচনায় উঠে এসেছে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের ভোট যাবে কোন বাক্সে। ইতিমধ্যে দীর্ঘ ৫ বছর পর ৩টি প্যানেলের উৎসবমুখর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে বার ভবন জুড়ে ছড়িয়ে পরেছে নির্বাচনী আমেজ। বিগত দিনে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা ওসমানদের প্রভাব খাটিয়ে এককভাবে জিম্মি করে রেখেছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতি।
কিন্তু গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালালে আওয়ামী লীগপন্থী দেড় শতাধিক আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতি ফেলে পালিয়ে যায়। যাকে ঘিরে যাকে ঘিরে দীর্ঘদিনপর রাহুমুক্ত হয় আইনজীবী সমিতি। কিন্তু বর্তমানে অভুন্থানের ১ বছর পেরিয়ে গেলে আদালতপাড়ায় বিরোধী দলের আইনজীবীদের উপরে নির্যাতনের কিং মেকার হিসেবে পরিচিতি হাসান ফেরদৌস জুয়েল, মোহসীন, কয়েকজন বাদে বাকি আইনজীবীপন্থী আইনজীবীরা ধীরে ধীরে আদালতপাড়া মুখী হচ্ছেন।
তা ছাড়া এই আইনজীবী সমিতিতিতে বিগত দিন থেকেই আওয়ামী লীগের একটি বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেই অনুযায়ী আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের ভোট যাদের দিকেই যাবে নির্বাচনে জয় তাদেরই হবে এমন একটি গুঞ্জন উঠে আসছে। যাকে ঘিরে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীতায় থাকা সকল আইনজীবীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের ভোট সংগ্রহ করা।
এদিকে বিগত দিন থেকেই আওয়ামী লীগের প্রধান শত্রু হিসেবে তালিকায় শীর্ষে ছিলেন বিএনপি। এর বাহিরে জামায়েত এর আইনজীবীদের সঙ্গে বিগত দিনে ও টুকটাক আলোচনা ছিলো বলে জানা গেছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের ভোট অর্জনের পিছনে কোনো আইনজীবীই প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা দেখাচ্ছেন না। তবে আড়ালে আবডালে ঠিকই আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। বর্তমানে প্রতিযোগীতায় থাকা বিএনপির সমর্থিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও জামায়েত ইসলামীর সমর্থিত বাংলাদেশ ‘ল’ ইর্য়াস ফোরাম এই দুই প্যানেল বর্তমানে হাট্টাহাট্টি লড়াইয়ে রয়েছেন। যার বাক্সে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের ভোট যাবে সেই প্যানেল জয়যুক্ত হবে বলে শোনা যাচ্ছে।
সূত্র বলছে, আগামী ২৮ আগষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর এবারের নির্বাচনে ৩টি প্যানেল নির্বাচন করছেন। বিএনপির জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের প্যানেলের বাইরে গিয়ে আরেকটি প্যানেল তৈরি হয়েছে। একই সাথে বিএনপির দীর্ঘদিনের শরীক দল জামায়াতে ইসলামীও আলাদাভাবে প্যানেল দিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে আইনজীবী সমিতির এবারের নির্বাচন ভোটের মাঠে গড়ালে সকল প্যানেলকেই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে। ভোটের মাঠে সকলকে লড়াই করেই নির্বাচনের ফসল গড়ে তুলতে হবে।
আর এই লড়াই থেকে বিজয় অর্জনের মূল বিষয়বস্তু হিসেবে পরিণত হয়েছেন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা। তারা যেদিকে মোড় নিবেন সেদিকেই নির্বাচনের ফলাফলের মোড় ঘুরবে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা বিগত প্রায় ১৬ বছরে নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়ায় বিএনপির আইনজীবীরাও স্বস্তিতে থাকতে পারেননি। তাদেরকেও নানাভাবে নির্যাতন নিপীড়ন অপমান অপদস্থ করেছেন । পাশাপাশি জামায়াত সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আইনজীবীরাও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। আইনজীবীরা নিরাপদে ভোট দিতে পারেননি। নির্বাচনের সময় বহিরাগতরা আদালতপাড়ায় এসে শোডাউন দিয়েছেন। আইনজীবীদেরকে হেনেস্তা করেছেন।
এরই মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আর এই পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়ায় আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরাও আত্মগোপনে চলে যান। তাদের এই আত্মগোপনে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর আইনজীবী সমিতির কর্তৃত্বে আসেন বিএনপির আইনজীবীরা। সেই সাথে বিএনপির অন্যান্য আইনজীবীরাও প্রভাব আধিপত্য ফিরে পান।
আইনজীবী সমিতির গত নির্বাচনে তাদের কোনো ভূমিকা ছিলো না। গত নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে যারা আইনজীবী সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমানে তারা সকলেই পলাতক রয়েছেন। ফলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার মতো কেউ নেই। যাকে ঘিরে বর্তমানে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা একবারেই নির্বাচনবিমুখ। কিন্তু ভোটে অংশ হয়ে ভোট প্রয়োগ করার ইচ্ছাপোষন করেছে অনেকেই এমনটা জানিয়েছে সূত্র।
এ দিকে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার মনোনীত এড. সরকার হুমায়ুন কবির ও এড. এইচএম আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে ১৭ পদে পূর্ণ প্যানেলের সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে এড. কাজী আঃ গাফ্ফার, সহ-সভাপতি পদে এড. সাদ্দাম হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে এড.ওমর ফারুক নয়ন, কোষাধ্যক্ষ পদে এড. শাহাজাদা দেওয়ান, আপ্যায়ন সম্পাদক পদে এড. মাইন উদ্দিন রেজা, , লাইব্রেরি সম্পাদক পদে এড. হাবিবুর রহমান , ক্রীড়া সম্পাদক পদে এড. আমিনুল ইসলাম, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে এড. সারোয়ার জাহান, সমাজসেবা সম্পাদক পদে এড. রাজিব মন্ডল, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক পদে এড. মামুন মাহমুদ, সদস্য পদে এড. আনিসুর রহমান, এড. ফাতেমা আক্তার সুইটি, এড. তেহসিন হাসান দিপু, এড. দেওয়ান আশরাফুল ইসলাম ও এড. আবু রায়হান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে বেরিয়ে বিএনপিন্থী আরেক গ্রুপ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য ফোরামের মনোনীত সভাপতি পদে রেজাউল করিম খান রেজা ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. গোলাম মোর্শেদ গালিবের নেতৃত্বে ১৪ জনের একটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. সামসুজ্জামান খোকা, সহ-সভাপতি মো. আনিসুর রহমান মোল্লা, , যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম.এ মোমেন, কোষাধ্যক্ষ মো. আফজাল হোসেন, আপ্যায়ন সম্পাদক মো. শাহ-আলম শামীম, লাইব্রেরী সম্পাদক আলী আজ্জম, ক্রীড়া সম্পাদক শহীদ সারোয়ার, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নার্গিস পারভীন, সমাজ সেবা সম্পাদক শাহনাজ পারভীন হীরা, আইন ও মানিবাধিকার মনি গাঙ্গুলী, সদস্য মো. আব্দুর রউফ ও মো. আনওয়ারুল আজিম চৌধুরী।
বিএনপির সাথে সমঝোতায় না এসে জেলা আইনজীবী সমিতি নির্বাচনে (২০২৫-২০২৬) জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত আইনজীবীদের সংগঠন বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিল মনোনীত ১৭ পদে পূর্ণ প্যানেল ঘোষণা দিয়ে সভাপতি অ্যাড. এ. হাফিজ মোল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক পদে অ্যাড. মোহা. মাঈন উদ্দিন মিয়া নেতৃত্বেধীন প্যানেলে সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে অ্যাড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর দেওয়ান, সহ-সভাপতি পদে অ্যাড. আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাধারণ সম্পাদক পদে অ্যাড. মোহা. মাঈন উদ্দিন মিয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে অ্যাড. আল আমিন, কোষাধ্যক্ষ পদে অ্যাড. ইস্রাফিল, আপ্যায়ন সম্পাদক পদে অ্যাড. মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন,
লাইব্রেরি সম্পাদক পদে অ্যাড. মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার, ক্রীড়া সম্পাদক পদে অ্যাড. ইমরান হোসেন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে অ্যাড. মো. মজিবুর রহমান, সমাজসেবা সম্পাদক পদে অ্যাড. নূরে আলম, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক পদে অ্যাড. মাসুদুর রহমান। এ ছাড়া সদস্য পদে পাঁচ প্রার্থী হলেন- হলেন অ্যাড. গোলাম মোস্তফা, অ্যাড. আফরোজা জাহান, অ্যাড. রাকিবুল হাসান, অ্যাড. সাইফুল ইসলাম ও অ্যাড. তাওফিকুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, মনোনয়ন দাখিলের সংগ্রহ ও দাখিলের শেষ তারিখ (১৩ আগষ্ট), যাচাই-বাছাই ও মনোনয়ন বৈধ তালিকা ঘোষণা (১৪ আগষ্ট) মনোনয়ন প্রত্যাহারের তারিখ ১৫ থেকে ১৮ আগষ্ট। চূড়ান্ত বৈধ প্রার্থী তালিকা (১৮ আগষ্ট) সর্বশেষ আগামী ২৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বর্তমানের নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের ভোট ব্যাংক বিএনপি নাকি জামায়েত এর বাক্সে যায় সেটা দেখার বিষয়।