
শব্দ দূষণে উদাসীন পরিবহন চালকরা
শব্দদূষণ রোধে কঠোর বিধিমালা থাকলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দূর্বলতার কারণে ভুগছে সাধারণ মানুষ। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার সড়কে বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র চললেও নীরবে সহ্য করে নেন নগরবাসী। বিগত ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শব্দ দূষণ প্রতিরোধে খামখেয়ালির পরিচয় দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন। বিগত তাদের কোন কর্মকান্ড দেখা যায় না গেলেও গত বছরের ৫ আগষ্টের পরে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দ দূষণ সচেতনতায় প্রশিক্ষণ ও অভিযান শুরু করেছে। তাদের এই অভিযানে নগরবাসী তেমন সুফল না পেলেও দীর্ঘ দিন শব্দ দূষণের যন্ত্রণা ভোগ করেছে নগরবাসি। এজন্য ভুক্তভোগীরা পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন। পাশাপাশি আইন-বিধিমালা সম্পর্কেও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের পূর্ণ ধারণা নেই বলেও তারা মনে করেন।
এদিকে সম্প্রতি দেখা যায় নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দ দুষণ নিয়ে জেলা শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ এবং শব্দ দূষণ রোধে অভিযান পরিচালনা করেছে। যদিও বিগিত সরকারের আমলে তাদের এমন কর্মকান্ডের তৎপরতা দেখা যায় নাই বলে জানান নগরবাসি। তবে বর্তমানে শব্দ দুষণ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎপরতাকে সাধু জানান নগরবাসি।
জানা যায়, গত ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ নারায়ণগঞ্জের বিজ্ঞ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার নাজমূল হুদার নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ থানার পুলিশ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তা সমম্বয়ে গঠিত একটি টীম কর্তৃক শব্দদূষণ বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো: মোবারক হোসেন প্রসিউকিশন প্রদান করেন। অভিযানে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এর ৮(১) বিধি লংঘন করায় বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ১৫(২) মোতাবেক নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলা শব্দদূষণকারী ২টি যানবাহন থেকে ১ হাজার টাকা জরিমানা ও ৬টি হর্ণ জব্দ করা হয়। নারায়ণগঞ্জে দূষণকারী কারখানা/প্রকল্পেরবিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের এ ধরণের অভিযান অব্যাহত থাকবে। এছাড়া একই দিনে নারায়ণগঞ্জ জালকুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে শব্দ দুষণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়া মোড়ে শব্দ দুষণের কোন নিয়ম কানুনকে তোয়াক্কা করছে না পরিবহন চালকরা। অযথাই তারা কারণ ছাড়াই হর্ণ বাজিয়ে শব্দ দুষণ করে নগরবাসিকে ভোগান্তিতে পরিনত করেছে। এতে করে পরিবহন চালকদের বেপরোয়া হর্ণ বাজানোর কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ ২ নম্বর রেলগেট মোড়, বাসস্ট্যান্ডসহ পুরো শহর জুড়ে পরিবহন চালক রিকশা চালক, ব্যাটারি চালিত পরিবহন চালকরা বেপরোয়াভাবে শব্দ দূষণ করে মানুষকে যন্ত্রণায় ফেলে ভোগান্তি তৈরী করছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, অতিরিক্ত শব্দদূষণ শিশুসহ সব বয়সের মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হয়, কর্মক্ষমতা কমে যায়, মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায় এবং বিশ্লেষণক্ষমতা কমে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব নয়েজ কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, স্নায়ুর সমস্যা, আলসার, মাথাব্যথা, উচ্চরক্তচাপ, আত্মহত্যার প্রবণতা, হৃদরাগের মতো জটিল রোগের কারণ হতে পারে উচ্চমাত্রার শব্দ। এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা শিশুরও জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁও, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জে শব্দদূষণ এক নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। শব্দদূষণের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। উপজেলাগুলোতে বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানসহ নানা সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইকে গান বাজানো একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে শব্দ দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে মাইক, পটকাবাজি, ডিজেলচালিত জেনারেটর, মিছিল, মিটিংয়ের স্লোগান ছাড়াও পরিবহনের হর্নে অতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। যার কারণে শব্দ দূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন এলাকায় দোয়া মাহফিল, ওয়াজ মাহফিল, ওরস, পূজামণ্ডপ ও বিয়েবাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত বাজে মাইক। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের কারণে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদ্র্র্র্রণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও এসব উপজেলায় তা প্রয়োগ হচ্ছে না।
উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস সূত্রে জানা গেছে, শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান থাকলেও তা কার্যকর না করায় মূলত শব্দদূষণের মাত্রা বাড়ছে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ যেমনটা হয়- পটকাবাজি (৯০-১২০ ডেসিবেল), ডিজেলচালিত জেনারেটর (৮০ ডেসিবল), মিছিল, মিটিংয়ে স্লোগান ও লাউড স্পিকার ও মাইকের মাধ্যমে (১১০ ডেসিবেল)।
আড়াইহাজারের পাঁচগাঁও এলাকার বাসিন্দা সোহেল রহমান। সড়কের পাশেই তার বাড়ি। তিনি বলেন, একে তো যানবাহনের হর্নের শব্দ। তার ওপর দিন-রাত মাইকের শব্দ। মনে হয় কান বেশি দিন ভালো থাকবে না।
এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে উচ্চশব্দে মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ও অসহনীয় শব্দদূষণে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। বিশেষ করে শিশু, অসুস্থ রোগী ও পরীক্ষার্থীদের বেশি সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। রিকশা, ইজিবাইক ও অটোরিকশায় মাইক ব্যবহার করে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচার চলছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ফলে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়গুলোতে দৈনন্দিন কাজ সারতে সমস্যায় পড়ছেন সংশ্লিষ্ট লোকজন।
শনিবার (১ মে) বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত নগরপাড়া এলাকায় অবস্থান করে দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সদর অন্তত তিনটি এনার্জি-এলইডি বাল্ব, একটি দোকানের প্রচার, একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রচার শোনা যায়। জাহাঙ্গীর মোল্লা, ফারুক ভূঁইয়া, বিল্লাল হোসেনসহ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, এভাবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিদিন উচ্চশব্দে মাইক বাজিয়ে বাল্ব বিক্রি, সভা-সমিতি, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের কর্মসূচি, ভোগ্যপণ্য, চিকিৎসকের সেবা, মলম-মাজন-ইঁদুরের ওষুধ বিক্রি, গরু-ছাগল জবাইসহ নানা প্রচারণা চালানো হয়। ফলে রাস্তার পাশে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল, অফিস, ব্যাংক-বিমার দাপ্তরিক কাজে ব্যাঘাত হচ্ছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আইভি ফেরদৌস বলেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত শব্দ মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে প্রবণশক্তি লোপসহ উচ্চ রক্তচাপ, মাথাধরা, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি বোধ, অনিদ্রা, হৃদ্যন্ত্রের সমস্যাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, শব্দদূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। তাদের মানসিক বিকাশের অন্তরায় শব্দদূষণ। শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের ওপরে হলে প্রবণশক্তি হ্রাস পায়। রূপগঞ্জের শব্দের মাত্রা ২০০ ডেসিবেলের ওপরে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রাশেদ মাহমুদ বলেন, প্রতিমাসে একটা অভিযান করি। রাস্তায় হাইড্রলিক হর্ন নিয়ে জরিমানা করা হয়। বিয়ে বাড়িতে বাদ্য-বাজনা সারারাত ধরে চলে। এটাতেও মানুষের সমস্যা হয়। তবে সামাজিক অনুষ্ঠান হওয়ার কারণে কেউ অভিযোগ দেন না। অভিযোগ পেলে দেখবো।
তিনি আরো বলেন, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এর ১৮ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বিধিমালার বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘন করে দোষি সাব্যস্ত হলে তিনি প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।