আসুন সবাই মিলে না.গঞ্জকে বাঁচাই

মাহফুজ সিহান/লতিফ রানা/ লিমন দেওয়ান/সালেহ আহমেদ
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

ক্যাপশন : ‘আমরা কেমন নারায়ণগঞ্জ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। ‘আমার নারায়ণগঞ্জ’ নামক সংগঠনক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। ছবি : মেহেদী হাসান।
নারায়ণগঞ্জে এমন ঐক্য শেষ কবে প্রত্যক্ষ করেছে নারায়ণগঞ্জবাসী তা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেনা। দল-মত-নির্বিশেষে প্রথম সারির প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশালী সমাজ ব্যবসায়ী সংগঠন, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ একত্রিত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে এবং এর সমাধানে একত্রিত হয়ে কাজ করতে। নারায়ণগঞ্জের যানজট, ফুটপাতে হকার সমস্যা, মাদক নিরসন, প্রশাসনে জটিলতা, নারায়ণগঞ্জকে এ ক্যাটাগরির জেলায় রূপান্তর, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা, নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীক সংগঠনগুলোতে নির্বাচনের ব্যবস্থা, চাঁদাবাজ সন্ত্রাসমুক্ত সুন্দর নারায়ণগঞ্জ গড়তে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।
গতকাল নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব ভবনের ৭ম তলায় ‘ আমরা কেমন নারায়ণগঞ্জ চাই?’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সুশাল সমাজসহ সকল শ্রেণিপেশার বিশিষ্ট জনেরা। ‘আমার নারায়ণগঞ্জ’ সংগঠনের সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হয়েছেন মডেল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিটিজেন ব্যাংক পিএলসি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাসুদুজ্জামান। গোলটেবিল বৈঠকে নারায়ণগঞ্জের নানাবিধ সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে বক্তব্য উপস্থাপন করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহবায়ক এড.সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব এড.আবু আল ইউসুফ খান টিপু, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমদ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রাইম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু জাফর আহমেদ বাবুল, বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি প্লামি ফ্যাশনস এর এমডি ফজলুল হক, জামায়াতে ইসলামী নারায়ণগঞ্জের আমীর মাওলানা আব্দুল জাব্বার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি, মানবাধিকারকর্মী ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এড.মাহবুবুর রহমান মাসুম, নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিকী, আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী নুরউদ্দিন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ, গণসংহতি আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ সমন্বয়ক তরিকুল সুজন, ন্যাপ নারায়ণগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক এড.আওলাদ হোসেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি আরিফ আলম দিপু, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জীবন প্রমুখ। গোলটেবিল বৈঠকে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে জেলা বিএনপি সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠক, শিক্ষাসাহিত্যে, সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা বিশিষ্টজন তাদের সম্বনয়ে এই সংগঠন থেকে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটির মাধ্যমে যে কোন সমস্যা হোক, কোন দুর্নীতি হোক, কোন ব্যাক্তির স্বার্থে এই নারায়ণগঞ্জের সম্মান ভুলণ্ঠিত করে এমন বিষয়ে কেউ যদি কমিটির কাছে অভিযোগ করে সেটা যাচাই-বাছাই করে একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এমন একটি ফোরাম এই সংগঠনের মাধ্যমে তৈরি করা যেতে পারে। জবাবদিহিতা থাকলে সর্বক্ষেত্রেই সকল দূর্নীতি কমে যাবে। আর আগামীতে আরো গুনিজ্ঞনী ব্যাক্তি যোগ করে এমন পোগ্রাম যদি প্রচলিত রাখা যায় তাহলে আজকের প্রোগ্রামের যে লক্ষ্য এটা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।’
মহানগর বিএনপির আহবায়ক এড. সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, নারায়ণগঞ্জে যে ৩৫টি হত্যা হয়েছে, সেই ৩৫টি হত্যার বিচার যাতে হয়। যারা হত্যা করেছে খুন করেছে, তাদের ফুটেজ যাদের কাছের আছে, তারা তা প্রশাসনকে দিবেন। তাদের বিচারে আপনারা অংশগ্রহণ করবেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে আজ যে ত্বকী হত্যা হয়েছে, সেই ত্বকী হত্যার বিচার নারায়ণগঞ্জে হবে ইনশাল্লাহ। আর ৭ খুনের যে রায় হয়েছে, তার বিচারও হবে ইনশাল্লাহ। আমাদের নারায়ণগঞ্জে যারা বিতর্কিত রয়েছেন, তাদের দিয়ে আগামীতে যে নির্বাচনগুলো হবে, সেই নির্বাচনগুলো আমরা প্রত্যাখান করবো।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা অনেক সম্মানিত ও পবিত্র। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধা নামে অনেক অনৈতিক কার্যকলাপ হয়। এই গডফাদারদের তো আরো গডফাদার আছে। যখনই আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ক্ষমতায় আসুক না কেনো, মুক্তিযোদ্ধা ট্যাগ লাগিয়ে গডফাদারদের আশেপাশে থাকতে চান। উনারা সেই গডফাদারদেরও বড় গডফাদার। সেই গডফাদার মুক্ত নারায়ণগঞ্জ চাই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য মাওলানা মঈনুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে এখনো কোন উন্নতি ফিরে আসেনি। সেই আগের মতোই যানজট, ফুটপাত, চাঁদাবাজি, আইনের শাসন, সন্ত্রাসী এখনো সব কিছু নির্মূল হয়ে যায়নি। আমরা যদি এই সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে সুন্দর নারায়ণগঞ্জ গড়তে চাই, তাহলে আগে আমাদের ভালো হতে হবে। আমরা নিজেরা ভালো না হয়ে ভালো নারায়ণগঞ্জ চাইবো এটা অবাস্তব। আমরা নিজেরা আগে যেমন ঘুষ দিতে অভ্যস্ত হয়ে ছিলাম, এখনো ঘুষ দিয়েই চলি। নারায়ণগঞ্জে যে ভ্যাট অফিস রয়েছে সেটা ঘুষের একটি বড় দালান। ব্যবসা যারা করেন তাদের প্রটাকশনে যে ভ্যাট ধার্য করা হয়েছে সে পরিমান ভ্যাট দিলে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে না।
সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহবায়ক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি বলেন, শহরে বের হলে এই শহরে কোন প্রশাসন বা মা-বাপ রয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না। এটি নিরসনের মূল দায়িত্ব হলো সিটি কর্পোরেশনের। সিটি কর্পোরেশনের এখানে কি নূন্যতম কোন ভূমিকা রয়েছে? ফুটপাত দখল করে রাস্তার অর্ধেক পর্যন্ত হকাররা দখল করে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় আমরা দেখেছি তাদের বাহিনী কিভাবে চাঁদা তুলেছে, কিভাবে এই দখল বাণিজ্য করেছে, আজকে কি চাঁদা তোলা বন্ধ হয়েছে, কেন এটা বন্ধ হয়নাই। সিটি কর্পোরেশন তার এই দায়িত্বটা কেন পালন করছে না। সিটি কর্পোরেশন তাদের এই মূল দায়িত্বগুলো পালন না করে, তারা নিয়োগ বাণিজ্যে নিয়োজিত হয়েছে। বিভিন্নজনকে তারা ২ লাখ, ৫ লাখ ৭ লাখ করে টাকা নিয়ে এখানে নিয়োগ দিচ্ছে। রিকশার লাইসেন্স দিয়ে তারা একটি বাণিজ্য করেছে। আমরা দেখেছি যে, নারায়ণগঞ্জে কিছু লোক রয়েছে, যারা নারায়ণগঞ্জে এসে কিছু ব্যবসা বাণিজ্য করে, নারায়ণগঞ্জে তারা থাকে না। নারায়ণগঞ্জের মানুষের কি অবস্থা এটা নিয়ে তাদের কোন মাথা-ব্যথা নেই। তারা যাচ্ছে তাই করে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এড.মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, আমাদের আরেকটি সমস্যা হলো বিকেএমইএ। এটা আমাদের নীটিং শিল্পের প্রাণ। এখানে ১৫ বছর এক ব্যক্তিই বিকেএমইএকে দখল করে রেখেছিল। ভালো ভালো ব্যবসায়ীয়দের দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। নিজেদের লোকদের ডেকে ডেকে এনে সেট করে দিয়েছে। এই বিকেএমইএতে আজকে শুধু একজন সভাপতি পরিবর্তন হয়েছে, পুরানো কমিটিই রয়ে গেছে, সেলিম ওসমানের মেয়ের জামাইও রয়ে গেছেন। সেলিম ওসমানের সেসব দোসর যারা নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে তারা রয়েই গেছে। কেন থাকবে তারা? একটা এজিএম ছাড়া বিকেএমইএর নেতৃত্বের পরিবর্তন হয় কি করে। অবাক লাগে, আজকে পিছন থেকে ইন্ধন দেয় একজন, তিনি মহামাজারী। বিকেএমইএ, ইয়ার্ন মার্চেন্ট, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, রাইফেল ক্লাব হেন নির্বাচন নাই, যে নির্বাচনে সে ইন্টারফেয়ার করে নাই। টাকার খেলা, ভোটের বিনিময়ে টাকা এই প্রবর্তক হচ্ছে এই মোহাম্মদ আলী। তিনি বহাল তবিয়তে আছে। যারা মামলা করেন, আপনারা দেখেন না, তার কীর্তিকলাপ আপনাদের নজরে আসে না? সে এখনও কেমন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে নাক গলায়। সমস্ত সমিতিগুলো এদেরে প্রভাবমুক্ত করতে হবে, এখানে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হয়েছেন মডেল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিটিজেন ব্যাংক পিএলসি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাসুদুজ্জামান বলেন, এফবিসিসিআই ভাঙ্গা হলে ও বিকেএমইএ কেন ভাঙা হলো না। তা নিয়ে আমাদের যে দুই ব্যবসায়ী ভাই বাণিজ্যে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন। আমি আশা করবো বাণিজ্যে মন্ত্রণালয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বর্তমানে ব্যবসায়ীদের বড় সংগঠন বিকেএমইএ এর মধ্যে যারা নেতৃত্বে আছেন তারা সকলেই অবৈধভাবে আছেন। গত (২৪ আগষ্ট) সেলিম ওসমান যে পদত্যাগ দিয়েছিলেন সেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে এবং ফোনে প্রেসার দিয়ে বলেছেন হাতেমকে প্রেসিডেন্ট দিতে হবে, কারণ উনি তার আঙ্গাবাহ। তাহলে প্রশ্ন রয়ে যায়, উনি কেন বলবেন, উনি তো পদত্যাগ করে চলেই গেছেন উনি তো এটা বলতে পারে না। এ ছাড়া কিছুদিন পূর্বে নাটক সাজিয়ে দুইজন বিকেএমএ এর পরিচালক পদত্যাগ করলেন। সে সময় হাতেম সাহেব আমার অফিসে গেলেন আরেকজন সহ-সভাপতির সাথে। সেখানে গিয়ে হাতেম সাহেব আমাকে প্রথম প্রশ্ন করেন পদত্যাগ এটা কি হলো! দ্বিতীয় প্রশ্ন উনি আমাকে বলেন যে, সেলিম ভাই আপনার সাথে একটু কথা বলতে চায়, আমি উনাকে বললাম, উনার সাথে আমি কেন কথা বলবো। বলে বিকেএমই‘এ এর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে চায়। আমি বলি সে তো পদত্যাগ করেছে দেড় মাস পূর্বে এখন এটা দিয়ে তার লাভ কি। এই হলো আমাদের হাতেম ভাইদের বর্তমান অবস্থা। তিনি বলেন, আমি এই প্রোগ্রাম থেকে ব্যবসায়ী ভাইদের উদ্দেশ্য বলতে চাই। উনারা গেছেন আর কখনো ফিরে আসবেন না। আপনারা আপনাদের মতো বের হন, বিকেএমই‘এ এর মধ্যে আসেন, কথা বলেন। আর সকলের অধিকার নিশ্চিত করেন। আমরা আসেন সকলেই ঐক্যবদ্ধ হই। আর এই তথাকথিত স্বৈরাচারের দোসর তারা যদি নিজে থেকে না যায় তাহলে আমরা রাস্তায় নামবো ইনশাআল্লাহ। আপনারা সকলেই পাশে থাইকেন।